বাংলাদেশ মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০২১

এইচআরএসএস এর বার্ষিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন।

স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক অনেক সাফল্য অর্জন করলেও আইনের শাসন, গনতন্ত্র ও জনগনের ভোটাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সামাজিক নিরাপত্তা, নারীর অধিকারসহ সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির আশাব্যঞ্চক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি । করোনা মহামারির ২য় ঢেউয়ের কারণে ২০২১ সালের প্রায় অর্ধেক সময় লকডাউন থাকলেও বাংলাদেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিহতি ছিল উদ্বেগজনক ও হতাশাব্যঞ্চক। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তি থাকা সত্তে¦ও বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।
বিগত বছরগুলোর মতো ২০২১ সালের বার্ষিক মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ বছরেও আইন শৃংখলা বাহিনী কর্তৃক বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড, প্রশাসনের হেফাজতে নির্যাতন, আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আইনবহির্ভূত আচরণ, ধরে নিয়ে যাওয়ার পর গুম করার অভিযোগ, গণপিটুনীতে মানুষ হত্যা অব্যাহত। বিশেষ করে এ বছরের মার্চ মাসে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং ব্রাম্মনবাড়িয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় ১৪ জন হেফাজতের দাবি ১৭ জন) মানুষ আইন শৃংখলা বাহিনী কর্তৃক বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয় ।
এ বছরের সর্বাধিক উদ্বেগজনক বিষয় হলো মত প্রকাশের ওপর হস্তক্ষেপ বিশেষকরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারাসমুহের অপপ্রয়োগ, মামলা ও গ্রেফতারের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হয়। প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে ১৭ মে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সচিবালয়ে হয়রানি ও নির্যাতন শেষে অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টে মামলা দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করার ঘটনা দেশে বিদেশে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয় ।
২০২১ সালের আর একটি উদ্বেগের বিষয় হলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, নির্যাতন ও সহিংসতার ঘটনাসমূহ । গত ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার এক পূজা মন্ডপে কুরআন শরীফ রাখাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির ও পূজা মন্ডপে হামলা এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটে।
নারীর প্রতি সহিংসতা এ বছরের আরেকটি উদ্বেগের বিষয় । বিশেষ করে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা, যৌতুকের জন্য হত্যা ও নির্যাতন, যৌন হয়রানি ও বাল্য বিবাহের ঘটনাসমুহ করোনা মহামারির মধ্যেও আশংখাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে ।
রাজনৈতিক সহিংসতা এবং সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ ও গ্রেফতার, সীমান্তে বিএসএফ্ কর্তৃক নিরীহ বাংলাদেশী হত্যা ও নির্যাতন এবং ব্যাপক নির্বাচনী সহিংসতার মধ্য দিয়ে দেশে বিরাজমান মানবাধিকার পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে উদ্বেগের চুড়ান্ত মাত্রায় পৌছেছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন গনমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং এইচআরএসএস এর তথ্য অনুসন্ধান ইউনিট ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের তথ্যের ভিত্তিতে বার্ষিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

## দৈনিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, এ বছরে এপর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী (ক্রসফাযার/ বন্দুকযুদ্ধ/সরাসরি গুলি/নির্যাতনে মৃত্যু) বিচার “বহির্ভূত হত্যাকান্ডে” আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ৮২ জন নিহত হয়। একই সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে/ সন্দেহে ৭ জনকে উঠিয়ে নেয়ার অভিযোগ করা হয়েছে।

## ২০২১ সালে এইচআরএসএস এর সংগৃহীত তথ্য ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৮৩৩ জন নারী, যাদের মধ্যে ৭৮৬ জন প্রাপ্ত বয়স্ক এবং আশঙ্কাজনকভাবে ১০৪৭ জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় যে ২৯৬ জন নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছে এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫২ জনকে। “নারী নির্যাতনের” অংশ হিসেবে ১৪৩ টি যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছে ৪২ জন নারী এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১১৩ জন নারী। এসিড নিক্ষেপের ২১ টি ঘটনায় নিহত হয়েছে ৪ জন এবং আহত হয়েছে ২৪ জন। অন্যদিকে, এটি উদ্বেগজনক যে ২০২১ সালে শিশুদের বিরুদ্ধে মোট ৩০৫ টি সহিংস ঘটনায় ১১১ জন প্রাণ হারিয়েেেছ এবং ২৫০ জন গুরতর আহত হয়েছে।

## আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ১৭৩টি হামলায় এ বছর “সাংবাদিক” আহত হয়েছে অন্ততপক্ষে ১২৭ জন, গ্রেফতার হয়েছে ২০ জন। এছাড়্ওা লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে ৩৪ জন এবং হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন ৫২ জন সাংবাদিক। একই সময়ে আশঙ্কাজনকভাবে, ডিজিটাল সুরক্ষা আইন ২০১৮ এর অধিনে দায়ের করা ২২১ টি মামলায় ১৮৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।“সংখ্যালঘু” স¤প্রদায়ের উপর ৮৫ টি হামলার ঘটনায় নিহত হয়েছে ০৩ জন, আহত হয়েছে ৫৯ জন এবং ৯৮ টি মন্দির ও ৩৫ টি বসতবাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে।

## “ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)” কর্তৃক ৩৮ টি হামলার ঘটনায় শারীরিক নির্যাতন ও গুলি করে ১৯ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করা হয়েছে, আহত করা হয়েছে ১০ জনকে এবং গ্রেফতার করা হয়েছে ৩০ জন।

## এ বছরে ৪৬০ টি “রাজনৈতিক সহিংসতার” ঘটনায় নিহত হয়েছে ৮২ জন, আহত হয়েছে ৪৩৫২ জন এবং গুলিবিদ্ধ হয়েছে ১৯৪ জন, যার অধিকাংশ ঘটনায় সরকার দলীয়কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটেছে। এদিকে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির (এলইএ) দ্বারা অমানবিক নির্যাতন ও গুলি চালানোর মোট ১৭৪ টি ঘটনায় ২৪৮৮ জন আহত হয়েছে, ৩২৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে এবং ৮৯ জন নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে।

## ২০২১ সালে নির্বাচনী সহিংসতার ৬৪৪ টি ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৪৩ জন এবং আহত হয়েছে ৫৪০১ জন । এ বছরে ৪৭ টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৭ জন, আহত হয়েছে ২০১ জন এবং গুলিবিদ্ধ ৮৪ জন। এছাড়াও “গণপিটুনির” ৮৩ টি ঘটনায় নিহত হয়েছে ৪৮ জন এবং আহত হয়েছে ৮৫।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে জনগনের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে না পারলে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যাবে। তাই “হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির ” পক্ষ থেকে দেশের সকল সচেতন নাগরিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও দেশি-বিদেশী মানবাধিকার সংগঠন গুলোকে আরো সোচ্চার হওয়ার আহবান জানাচ্ছি।